আমার কাছে প্রতিদিন এমন প্রশ্ন আসে যে আপা কীভাবে আমার বাচ্চার ব্রেন শার্প হবে। কী খাওয়াবো,কী করাবো। দেখুন একেক বয়সের বাচ্চার চাহিদা একেক রকম।সেটি কোনোভাবেই একরকম হবেনা।তাই একজন পুষ্টিবিদের কাছ থেকে আপনার বাচ্চার ফুড চার্ট করে নিন,যাতে করে ভবিষ্যতে এই শিশুটি দেশের সম্পদ ও আপনার মূল্যবান রত্ন হয়ে উঠতে পারে।তবুও পরামর্শ তো অবশ্যই আমি দিবো। সেক্ষেত্রে চলুন জেনে নেই কোন খাবারগুলো আপনার শিশুর মেধা বিকাশে কাজে লাগবে–
বাদাম
শিশুকে প্রতিদিনই কয়েকটি করে বাদাম খেতে দিন। কারণ বাদামে রয়েছে ভিটামিন ‘ই’ যা মস্তিষ্কের সমন্বয় সাধনের ক্ষমতা বাড়ায়। কাজুবাদাম, আখরোট, আলমন্ড, পেস্তা বাদাম, চীনাবাদামসহ যে কোনো ধরনের বাদামই শিশুর মানসিক বৃদ্ধিতে সহায়ক। তাছাড়া বাদামে আছে ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম ইত্যাদি যা শিশুর মস্তিষ্ককে তো ভালো রাখেই, পাশাপাশি দেহে রক্ত ও অক্সিজেন সরবরাহ উন্নত করে এবং হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য বজায় রাখে। তবে বাদাম বাচ্চার হজম হয় কীনা এবং এলার্জি আছে কিনা তাও পর্যবেক্ষণ করবেন,হজমে সমস্যা বা এলার্জি হলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে বন্ধ করে দিবেন।
ডিম
ডিম একটি পুষ্টিকর খাবার। ডিম মস্তিষ্কের বিকাশে অত্যন্ত উপকারী।কারণ এতে রয়েছে কোলিন, ভিটামিন বি ১২,প্রোটিন,সেলেনিয়াম সহ সকল গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা বাচ্চার ব্রেনের জন্য খুবই উপকারী।
কোলিন হ‘ল এমন একটি পুষ্টি যা মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
২০২০ সালের ৫০ টির বেশি গবেষণার পর্যালোচনাতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল যে “শিশুর প্রথম দিকে অর্থাৎ জন্মের পর থেকে ১০০০ দিনের মধ্যে যেসব শিশুর ডায়েটে কোলিন যুক্ত করা হয়েছে তাদের মস্তিষ্ক বিকাশ অন্য শিশুর তুলনায় বেশ ভালো ছিলো।
”স্নায়ু কোষের ক্ষতির বিরুদ্ধে রক্ষা করতে এবং ব্রেন শার্প করতে উন্নত করতে কোলিনের জুড়ি নেই।
দুটি পুরো ডিম ২৯৪ গ্রাম কোলিন সরবরাহ করে, যা ১–৮ বছর বয়সের বাচ্চাদের এবং ৯–১০ বছর বয়সী কিশোর কিশোরীদের ৭৫% এরও বেশি কোলিনের চাহিদা সরবরাহ করে,আইকিউ স্কোর বাড়াতে এটিঅত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিমের কোলেস্টরল নিয়ে অনেকেরই উদ্বেগ থাকে। এ উদ্বেগ ঝেড়ে ফেলে দিন।প্রতিদিন একটি ডিম আপনার বাচ্চাকে নিশ্চিন্তে খাওয়াতে পারবেন
সীফুড বা সামুদ্রিক মাছ
ওমেগা –৩, আয়োডিন এবং জিংক সহ মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এমন অনেক পুষ্টির সমগ্র খাদ্য হচ্ছে সামুদ্রিক খাবার। এক্ষেত্রে সামুদ্রিক মাছের কথা প্রথমেই আসে। কারন এতে ডিএইচএ এবং ইপিএ থাকে, যা পরবর্তী সময়ে শিশুর বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে।
এরপর আসি থাইরয়েড হরমোন নিয়ে। এ হরমোন শিশুর জন্য অত্যন্ত জরুরী কারন তা মস্তিষ্কের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। থাইরয়েড তৈরি করতে আয়োডিনের দরকার হয়। সেই আয়োডিনও সমুদ্রের খাদ্যে রয়েছে। প্রচুর গবেষণা প্রমাণ করেছে যে শিশু এবং কিশোর–কিশোরীদের মধ্যে আইকিউ স্কোর ভালো হওয়ার পেছনে সীফুড জড়িত। উচ্চ আইকিউ স্কোর এবং বাচ্চাদের মধ্যে স্কুলের পারফরম্যান্সের উন্নত হওয়ার সাথে সামুদ্রিক মাছ খাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে।
সুস্থ থাকতে প্রচুর পরিমান ওমেগা ৩ প্রয়োজন হয়। কারণ মস্তিষ্কের জ্বালানী হিসেবে কাজ করে ওমেগা ৩। তৈলাক্ত মাছে তা রয়েছে অনেক বেশি। বিশেষ করে স্যালমন,সামুদ্রিক পোনা ও মিঠা পানির বড় মাছ। ২০১৭ সালের আলঝাইমার ডিজিজের জার্নালে একটি পরীক্ষায় দেখা যায় যে ওমেগা ৩ এর ঘাটতিতে নিউরোডিজেনারেটিভ ডিসঅর্ডার যুক্ত হয়েছে। তবে পুষ্টিবিদরা এও বলেছেন অতিরিক্ত সামুদ্রিক খাবার গ্রহণ করা যাবেনা। পরামর্শ অনুযায়ী সপ্তাহে ২/৩ দিন সামর্থ্য অনুযায়ী দিয়ে থাকতে পারে।
শাকসবজী
আপনার বাচ্চাকে শাকসবজী খাওয়ানো চ্যালেঞ্জ হতে পারে তবে গবেষণায় জানা যায় যে এই পুষ্টিকর শাকসবজি বাচ্চাদের মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
পালং শাক,লেটুস পাতা ইত্যাদি সবুজ শাক–সবজিতে রয়েছে ফোলেট, ফ্ল্যাভোনয়েডস, ক্যারোটিনয়েডস এবং ভিটামিন ই এবং কে। এছাড়াও ব্রকলি, গাজর, টমেটো, বিনস ইত্যাদিও দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় তো রাখতে হবেই।এগুলোতে লুটেইন নামে অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট থাকে, যা মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে সকল শিশু পর্যাপ্ত ফোলেট গ্রহণ করেছে তাদের আইকিউ স্কোর অন্য বাচ্চাদের তুলনায় বেশ ভালো। এছাড়াও, গবেষণা পরামর্শ দেয় যে ক্যারোটিনয়েড সমৃদ্ধ খাবার শিশুদের মস্তিষ্ক বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে। উদাহরণ গাজর। ব্রেইনের জন্য আয়রনও খুবই দরকারি। লালশাক, মুলাশাক, ডাটাশাক, সরিষাশাক, হেলেঞ্চাশাক, ধনেপাতা, পুদিনাপাতা, থানকুনি পাতা ইত্যাদিতে রয়েছে প্রচুর পরিমানে আয়রন, আঁশ যা আপনার আদরের বাচ্চার মস্তিষ্ক বিকাশে কাজ করবে।
ওটমিল
স্মৃতিশক্তি বাড়ানো এবং সঠিক বুদ্ধির বিকাশে ওটমিলের কোনও জুরিই নেই। শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশে ওটস চমৎকার কাজ করে। এটি মস্তিষ্কের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে। ওটসে প্রচুর পরিমাণে আঁশ থাকে এবং সেই সঙ্গে এটি ভিটামিন ই, ভিটামিন বি, জিঙ্ক ও পটাশিয়ামের একটি ভালো উৎস, যা শিশুর দৈহিক বৃদ্ধির পাশাপাশি মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। তাই শিশুর সকালের নাশতায় ওটস রাখা হলে বেশ ভালো উপকার পাওয়া যায়। সকাল সকাল বাচ্চাকে যদি পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য দিতে চান, তা হলে ওটমিল খাওয়াতে পারেন। কার্বোহাইড্রেটের মিশ্রণ দিনভর শক্তি জোগায় শরীরে। বাচ্চা থাকে চনমনে। তবে এতে মিষ্টি মেশানোর বিষয়ে সচেতন থাকবেন। দু’বছরের বাচ্চাকে দিনপ্রতি এক কাপ করে ওটমিল দিতে পারেন। দুই–তিন বছরের বাচ্চাকে প্রতিদিন দেড় কাপ দিতে পারেন।
কোন ওটমিল ব্র্যান্ডটি ভালো এবং ওটমিলের রেসিপি জানতে এই লিংকটি ক্লিক করুন https://smartparenting.family/bn/oats-porridge-recipe-benefits/
ভিটামিন ডিযুক্ত খাবার
মস্তিষ্কের ক্রিয়া এবং বৃদ্ধির জন্য ভিটামিন ডি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় ভিটামিন ডি এর ঘাটতি শৈশবকালীন প্রতিবন্ধী নিউরোডোভালপমেন্টের সাথে জড়িত। ভিটামিন ডি নিউরোপ্রোটেকটিভ যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে এবং ক্যালসিয়ামের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। এটি মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনেক জিনকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ভিটামিন ডি ভিটামিন হিসাবে বিবেচিত হলেও এটি নিউরোস্টেরয়েড হিসাবে কাজ করে এবং মস্তিষ্ক বিকাশে একটি অসম্ভহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। পনির, গরুর মাংস, কলিজা,ডিমের কুসুম ইত্যাদি খাবারে প্রচুর ভিটামিন ডি থাকে। গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরে ভিটামিন ডির অভাব হলে শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ সঠিকভাবে হবে না বলে গর্ভবতী মাকে ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার খাওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত সূর্যের আলোয়ও কিছু সময় করে থাকতে হবে। খাদ্যতালিকায় দুধ বা দইও রাখতে হবে।এছাড়া সাপ্লিমেন্টারি প্রয়োজন হলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিবে। তাছাড়াও বাচ্চা জন্ম থেকে বড় হতে হতেও ভিটামিন ডি জাতীয় খাদ্য গ্রহন করবে ও পাশাপাশি সকালবেলা রোদ পোহাবে নিয়মিতো। আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন ডি কতোটা উপকারী আপনার শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশে।
ভিটামিন ডি-এর সবচেয়ে ভালো উৎস হলো সূর্যালোক। আপনার শিশুর জন্য ভিটামিন ডি এবং সূর্যালোকের গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে এই লিংকটি ক্লিক করুন https://smartparenting.family/bn/sunlight-for-babies/
মস্তিষ্কের খাবার দুধ ও দই
দুগ্ধজাত খাবারে প্রোটিন এবং ভিটামিন বি থাকে যা মস্তিষ্কের টিস্যু,নিউরোট্রান্সমিটার এবং এনজাইম বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয়।দুধ এবং দই প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেটের দারুণ একটি মিশ্রণ।
সাম্প্রতিক গবেষণা পরামর্শ দেয় দুধ এবং দই মস্তিষ্কের নিউরোমাসকুলার সিস্টেম এবং মানব কোষের সামগ্রিক জীবনচক্রকে উপকৃত করে থাকে। এছাড়া বাচ্চাদের জন্য দুধ মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান কোলিনও সরবরাহ করে থাকে। গর্ভবতী মহিলাদের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কারণ এটি শিশুদের প্রথম দিকে মস্তিষ্কের বিকাশে ভুমিকা রাখে। তাই দুধকে অবহেলা করবেন না। তবে অনেক বাচ্চাদের ল্যাকটোজেন ইনটলারেন্স থাকে। সেক্ষেত্রে বাচ্চা দুগ্ধজাত খাদ্য হিসেবে দই নিতে পারে ছানা নিতে পারে। বিকল্প খাদ্য গ্রহন করতে পারবে শিশু কিন্তু আবার দোকানের যেসব প্যাকেটজাত চকলেট দুধ পাওয়া যায় সেসব খাবার ভুলে দিবেন না।
ডাল ও খিঁচুড়ী
নিয়মিত ডাল খেলে আপনার বাচ্চার মস্তিষ্ক আপনাকে ধন্যবাদ জানাবে।মসুর ডালের ভিটামিন–বি মস্তিষ্কের জ্ঞান বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।ডালের ভিটামিন অ্যামাইনো এসিড ও হোমোসিস্টিনের মাত্রা হ্রাস করে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারন,এইগুলি বেশি মাত্রায় থাকলে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ব্যাহত হয়।এইজন্য ডাল চালের খিঁচুড়ীরে বলা হয় গরীবের যাদুকরী খাদ্য বলে। এক থালা খিচুড়িতে প্রায় ১৭৭ ক্যালরি শক্তি, ৩২.৩ গ্রাম শর্করা, ৮.৪ গ্রাম প্রোটিন, ১.৫ গ্রাম চর্বি থাকে। এছাড়াও ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি, আয়রন এবং ফাইবার বা আঁশ রয়েছে।যার প্রত্যেকটি বিষয় মস্তিষ্ক গঠনে কাজ করে।তাই ডাল ও খিঁচুড়ী আপনার শিশুর জন্য যাদুকরী খাদ্য।
অবশ্যই শিশুর যাতে পরিপূর্ণ ঘুম হয় তা খেয়াল রাখবেন। মনে রাখবেন আপনি আপনার বাচ্চাকে দুনিয়ার মুখ দেখিয়েছেন। তার উপর কোনো কিছু চাপিয়ে দিবেন না। তাতে করে তার ব্রেনের বিকাশ তো ঘটবেই না,উল্টো একটি অসুস্থ মস্তিষ্ক নিয়ে দিন দিন বড় হবে।তাই শুরু থেকেই সাবধান।